আজকাল সকাল বেলা উঠে পত্রিকা খুললে বা নিউজ ওয়াল ঘাটলেই চোখে পড়ে ধর্ষণের খবর। বিষয় টা এমন পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে যেনো প্রাত্যহিক চালচিত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে শুরু করে গণপরিবহন কোথাও অবিশিষ্ট নাই যেখানে কোনো না কোনো নারী ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছেননা। নিজের ঘরে যৌন নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন এমন অহরহ সংবাদ দেখা যাচ্ছে প্রায়শই।এক দেড় বছরের বাচ্চা হতে শুরু করে ষাঁট সত্তর বছরের বৃদ্ধা ও ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছেন। তাহলে একটা নারীর নিরাপত্তা কোথায়?ধর্মীয় উপাসনালয়ে, কারাগারে, হাসপাতালে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাকি নিজের ঘরে?
এইতো দশ বারো বছর আগে ও যখন স্কুলে পড়তাম চলতে ফিরতে কখনো ভাবতাম না যে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা। গ্রামে বড় হওয়া সেই সুবাদে কতো মাঠে ঘাটে দৌড়াদৌড়ি করেছি খেলা করেছি।প্রায় ই দেখা যেতো মাঠে অনেক বাচ্চারা খেলতেছি খেলতে খেলতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়াল ই নাই পরে তো মার বকুনি খেয়ে ফিরতে হতো ঘরে। তবু ও মনে কোনো সংশয় ছিলনা।
এখন আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি স্বাভাবিক ভাবে ই এখন তো নিশ্চিন্তে চলার কথা কিন্তু প্রতিটা সকাল ই শুরু হয় এক বিভীষিকা ময় ভাবনায় ভর করে আর তা হলো আজকের ভিক্টিম কে হচ্ছেন আমি নইতো?এখন যদি বাড়ি ফেরার আগে পথে ঘাটে সন্ধ্যা নেমে আসে তবে দুশ্চিন্তায় হার্ট বিট বেড়ে যায় এই ভেবে যে আজ কি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবো? আমরা এখন দিন দিন ডিজিটাল হচ্ছি বেশিরভাগ মানুষ ই উচ্চ ডিগ্রি নিচ্ছি কিন্তু আমরা কি নৈতিকতা শিখছি?
আমাদের নৈতিকতা বোধ নিচে নামতে নামতে এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আমরা মানুষের অবয়বে পশুত্ব বহন করে চলেছি নিত্যদিন। আজকাল একটা ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হলে তার কমেন্ট বক্সে গিয়ে দেখবেন আমরা কতোটা মূল্যবোধ লালন করি। সেখানে অতি উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞজন হতে শুরু করে অনেকে ই দেখবেন ধর্ষণের পক্ষপাতিত্ব করে চলেছেন পরোক্ষ ভাবে।
কেউ কেউ বলবে মেয়েটার পোশাক ভাল ছিলো না উচিত কাজ ই হইছে, কেউ বলবে মেয়েটার চলন ভালো ছিলোনা তাই হয়েছে, আবার যখন দেখবেন একটা বোরকা পড়া মেয়ে ভিক্টিম হয়েছে তখন ও দেখবেন কেউ কেউ বলেছে আরে এ কেমন মেয়ে বোরকা পড়ে আবার ছেলেদের সামনে গিয়েছে নিশ্চয় ই মেয়ের সমস্যা ছিলো।
এইবার আসেন আরেক পক্ষ তারা সেই মাপের প্রতিবাদী, ফেসবুক ওয়ালে সমবেদনা বিচার দাবি যুক্তি খন্ডন সব ই করে ফেলতেছেন। এতো প্রতিবাদী কন্ঠ এতো সহমর্মিতা বান্ধব মানুষ থেকে ও আমাদের সমাজে র এই দুরাবস্থা কেন? এর অনেকগুলা কারনের মধ্যে একটা হলো আমাদের নৈতিকতাবোধ টা মুখে মুখে বা ফেসবুক ওয়ালে ই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে । যে ছেলেটা দেখবেন আজ এক ধর্ষিতা মেয়েকে নিয়ে ফেসবুক ওয়াল কাপাচ্ছে বিচার চেয়ে কাল গিয়ে দেখবেন সে তার বোনের পাশে হাটা মেয়েটাকে “মাল” বলে সম্বোধন করছে। তার মায়ের পাশে দাড়িয়ে থাকা মহিলাটার দিকে কু-দৃষ্টি তে তাকাচ্ছে।
আমি নিজে প্রত্যক্ষদর্শী একটা ঘটনার। ভিক্টিম যৌন হয়রানি র স্বীকার হয়েছিলেন। তার আশে পাশে থাকা শিক্ষিত বিজ্ঞ লোক গুলা বলেছিলেন আরে মাইয়া কি ভালা নি ভালা হইলে কি আর কেউ ডিস্টার্ব করে? কিন্তু এ ঘটনা টা যদি আবার তাদের ই পরিবারের কারো সাথে ঘটতো তাহলে কি তারা এটা বলতে পারতেন? আমাদের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর পরিবর্তন না হলে কখনো ই সমাজ বদলাবেনা।
আমাদের সমাজে এমন অনেক হাতিম তাই আছেন যারা একজন ভিক্টিমের জন্য মিটিং মিটিং মিছিল করে ফাটাতে রাজি কিন্তু ভিক্টিমের পাশে দাড়াতে রাজি নন। এমন একটা লোক ও কি আমাদের সমাজে খুজে পাওয়া যাবে যিনি একজন ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করেছেন বা করবেন? না কখনো ই না। কিন্তু এমন অহরহ ছেলে পাবেন যারা অন্যের বউ ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে জান জীবন দিতে ও রাজি।আমরা কখনো ই মহৎ হতে আগ্রহী নই আমরা মহত্ত্ব ফলাতে পটু, যতোদিন না আমাদের চিন্তাভাবনা প্রসারিত না হবে, আমাদের চিত্ত উদার না হবে ততোদিন সমাজ হতে এসব দূরীকরণ সম্ভব হবেনা। আমাদের নৈতিকতা শিক্ষা টা পরিবার হতে শুরু করতে হবে। আপনার কাছে আপনার বোন টা যদি কলিজা হয় আপনার বোনের পাশে হাটা মেয়েটা মাল কেনো হবেরে ভাই? পরিবর্তন টা নিজেকে দিয়ে শুরু করুন নিজের পরিবার কে দিয়ে শুরু করুন৷একটা সময় দেখবেন সমাজ টাই বদলে গেছে৷ প্রতিটা মা, বোন, প্রতিটা মেয়ে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করার মতো একটা সমাজ গড়ে উঠুক৷ আবার প্রতিটা ভোরের সূর্য উদয় হোক নিরাপদে চলতে পারার প্রশান্তি নিয়ে।
লেখিকা: এলাচি আক্তার প্রিয়া, গনিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।