খন্দকার ইউনুস ফাহাদ, ইউরোপ থেকেঃ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বছরের শুরুতে বিদ্যালয়ে পড়াশুনার চাপ কম থাকায়, প্রতিদিন ১/২টা ক্লাস শেষেই শুরু হয় সাধারণত শরীরচর্চা ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি।আমার দেখা বছরের এই সময়ে,স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুশীলনে ছেলেদের চেয়ে স্কাউটে মেয়েদের সংখ্যাটাই থাকত বেশি।
মূলত মেয়েদের সংখ্যা কমাতে অল্প একটু এদিক সেদিক হলেই ফাইনালের আগে বাদ পড়ত অনেক মেয়েরা। বান্ধবী বা পরিচিত কেউ বাদ পড়লে, তার জন্য খারাপ লাগত। কারন এর থেকে কম পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে ঠিকে যেত অনেক ছেলেরা। যার সাথে একটু ভাল সম্পর্ক বুদ্ধি দিতাম আগামীকাল অন্যদিকে অন্যমেয়েদের সাথে দাঁড়াতে, স্যার ভুলে যেত বুদ্ধিও কাজে লাগত!
এদিকে প্রতিদিন স্কুলের এসেম্বলিতে ইচ্ছে থাকলেও সামনে গিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে পারতাম না। কারন সেখানে ছেলেদের নিত দুই/তিনজন আর সকাল সকাল ভেজা চুলের ললনারাই থাকত বেশি! যে দুইজন ছেলে থাকত, সেখান থেকে একজন মেধাবী সুবোধ বালক আরেকজন কোন শিক্ষকের ছেলে। অর্থাৎ ডানপিটে আমাদের মত একটু অমনযোগী ছেলেদের জন্য ছিল কঠিন প্রতিযোগিতা! বিদ্যালয়ে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে রচনা প্রতিযোগিতায় শত শত ছেলেমেয়েরা তাদের রচনা জমা দিত। সেখানে ছেলেদের ঠিকে থাকা ছিল আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের। কারন বেশিরভাগ মেয়েদের হাতের লেখা প্রকৃতগত ভাবেই ছেলেদের থেকে একটু সুন্দর হয়! যদিও ধীরে ধীরে সময় নিয়ে লিখলে ছেলেমেয়ে যে কারও হাতের লেখাই সুন্দর হতে পারে। তবুও মেয়েদের হাতে লেখা চিঠি আর রচনার বর্ণমালা কেন জানি আমার কাছে মনে হয় বিধাতারই একটা সুন্দরের ইশারা!
আর একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেক মেয়েরাই আসত ছেলেদের আগে।মেয়েরা আগে আসার কারন তারা ফুল পাবে কোথায়?তাহারা তো গভীর রাতে অন্য কারো বাগান থেকে ফুল চুরি করতে যেতে পারেনা!ভোরে মেয়েরা ছেলে বন্ধুদের কাছ থেকে আগে ফুল নিত।তারপর শহীদ মিনারে এসে ছেলেদের আগে মানে সামনের কাতার থেকেই শ্রদ্ধা জানাতো।ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপারটাও এই ফুলের সাথে বলে দিত কেউ কেউ!তখন ভ্যালেন্টাইন আবেদন গ্রাম পর্যন্ত এতটা টের পায়নি।
আজকের ভ্যালেন্টাইন কিংবা বসন্ত ছুঁয়ে কত মেয়ে লাল, হলুদ শাড়ী পড়ে বের হচ্ছে। সংখ্যাটাও অনেক বেশি।কিন্তু সেই স্কাউট, এসেম্বলি, রচনা প্রতিযোগিতা আর একুশের প্রভাতফেরীর মিছিলে মেয়েদের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে দিন দিন। প্রতিটা মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইলের About এ দেখছি লেখা I hate politics. এটা খুব ভাল বার্তা নয় উপমহাদেশ তথা আমাদের ভাষা শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতির জন্য। এখানে যতই ঘুমিয়ে থাকবেন ততই উগ্রপন্থীরা সুযোগ নিবে রমনার বটমূলে, সিনেমা হলে, আদালতে, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় কিংবা গুলশান হলি আর্টিজানে!
কোন একটা রাজনৈতিক দলের অপকর্মের জন্য রাজনীতি বিষয়টাকেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়। প্রজন্মের উত্তরাধিকার, মায়েদের জাতি মেয়েদের তো অবশ্যই রাজনীতিতে নীরব থাকা উচিত নয়।
সবার জন্য পলিটিক্স পছন্দ করতেই হবে বিষয়টা এমন নয় কিন্তু এভাবে ঘৃণা করতে থাকলে দেশপ্রেমটা সমাজ থেকে হ্রাস পাওয়ার আগে ঘর থেকেই হ্রাস পাওয়া শুরু হবে! একুশের প্রভাতফেরিতে ফুলহাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার লাইনটা আরো লম্বা চাই..জেগো উঠুক আই হেইট পলিটিক্স জেনারেশনের তরুন তরুণীরা। অবশ্য মেয়েদের রাজনীতিতে অনাগ্রহ করে তুলতে, সুশীলদের একটা অংশ সারাবছর নারী জাগরণে কিংবা মেয়েদেরকে মিছিলে, স্লোগানে দেখলেই তাদেরকে চরিত্রহীন বলতে বলতেই মিডিয়া কাঁপায়। ফলে শিশুদের দেশপ্রেম হারিয়ে যাচ্ছে তার মায়ের অনাগ্রহ অর্থাৎ অনুভূতির ভ্রুণ থেকেই।
পলিটিক্স মানেই প্রতীক সংবলিত কোন পার্টি নয়, বরং দেশপ্রেমে নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু যোগ্য হিসেবে দাঁড় করবার প্রতিযোগিতা মাত্র। আর রাজনৈতিক দল হলো সেই যোগ্যতা চর্চার উত্তম চর্চাকেন্দ্র।
একজন রাজনীতি প্রিয় মানুষ খুব বেশি পরিবর্তন ঘটাতে না পারলেও অন্তত তার দ্বারা ক্ষুদ্র একটা জায়গায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা খুব অস্বাভাবিক কিংবা কঠিন কিছু নয়।
আমাদের ভাষা,ভালবাসা,রাজনীতি সমভাবে চর্চা হোক সার্বজনীন।