নামাজ মুমিনের অন্যতম প্রধান ইবাদত। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার উপর আরোপিত সকল ইবাদতের মধ্যে নামাজ এমন একটি ইবাদত যা ব্যক্তিজীবনকে গড়ে তুলে মুমিন হিসেবে আর সমাজ জীবনে ব্যক্তি কে গড়ে তুলে সুবাসিত পুষ্প তুললে। নামাজের মাধ্যমেই জীবনের সর্বাঙ্গীন সফলতা লাভ করা যায়।ইসলামী শরীয়ত প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির উপর দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছে।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে এই ৫ ওয়াক্ত নামাজ কে ফরজ ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে: আর তারা যা বলে সে সম্পর্কে আপনি ধৈর্যধারণ করুন আর আপনি নামাজ আদায় করুন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে, রাত্রিকালে এবং দিবসের প্রান্ত সমূহে, যাতে করে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার। (সূরা ত্বহা: ১৩০)
উক্ত আয়াতে সূর্যোদয়ের পূর্বে এই শব্দ দ্বারা ফজরের নামাজ, দিনের প্রান্ত সমুহে এই শব্দ দ্বারা জোহরের নামাজ, সূর্যাস্তের পূর্বে এই শব্দ দ্বারা আসরের নামাজ, রাত্রির মধ্যখানে এই শব্দ দ্বারা মাগরিব ও এশার নামাজ কে বোঝানো হয়েছে।
আমাদের দেশে সালাত ইবাদতটি নামাজ হিসেবে পরিচিত। নামায শব্দটি হল ফার্সি, যাকে আরবীতে বলা হয় সালাত। সালাত শব্দটি স্থান,কাল ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথাঃ আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হলে সালাত এর অর্থ হবে দয়া ও অনুগ্রহ। বান্দার সাথে সম্পৃক্ত হলে এর অর্থ হবে প্রার্থনা। তেমনিভাবে ফেরেশতার সাথে সম্পৃক্ত হলে অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। নবীর সাথে সম্পৃক্ত হলে দরুদ পড়া। পশু পাখির সাথে সম্পৃক্ত হলে অর্থ হবে তাসবিহ পড়া। পারিভাষিক অর্থে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্ধারিত ইবাদত আদায়ের নাম সালাত।
নামাজের গুরুত্ব:
ঈমানের পরে নামাজের স্থান। নামাযই এমন এক এবাদত যা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মুসলমানের উপর সর্বদা সর্বাবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরজ। নামাজের গুরুত্ব এতই বেশি যার কারণে পবিত্র কোরআনের ৮২ স্থানে বিভিন্ন ভাবে নামাজের আবশ্যকীয়তা বুঝানো হয়েছে।নামাজের ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারকারী কাফের। নামাজ অস্বীকার করলে সে ব্যক্তির আর নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেওয়ার কোন অধিকার থাকেনা।
নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বে-খবর (সূরা মাউন ৩ ও ৫ নং আয়াত)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, নিঃসন্দেহে নামাজ যথেষ্ট কঠিন কাজ, তবে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি আছে তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়. (সূরা বাকারা ৪৫)
রাসুল সা. এর বানিতেও নামাজের গুরুত্বের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়, তোমাদের ছেলে মেয়েদের বয়স ৭ বছর হলে নামাজ পড়তে আদেশ কর এবং ১০ বছরে (নামাজ না পড়লে) প্রহার কর এবং তাদের শয্যা পৃথক করে দাও। (তিরমিজি, আবু দাউদ)
সফরের সময় বা অসুস্থ অবস্থায় রোজা ফরজ নয় তেমনি ভাবে গরিব হলে হজ্ব আদায় করতে হয় না, নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে যাকাত ফরজ নয় কিন্তু সর্বাবস্থায় নামাজ ফরজ। কোন অবস্থাতেই নামাজ মাফ হয় না।
এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো, যদি না পারো তবে বসে পড়ো। তাতেও অপারগ হলে শুয়ে বা ইশারায় পড়ো তবুও নামাজে মাফ নেই। (বুখারী)
সাহাবায়ে কেরামগণ কি পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে নামাজ আদায় করতেন তার কিছু নমুনা নিম্নে দেওয়া হল:
সাহাবায়ে কেরাম যখন নামাজে দাঁড়াতেন, পাখিরা তাদেরকে বৃক্ষ মনে করে তাদের মাথার উপর বসে জিকিরে সুর তুলত।
নামাজে থাকা অবস্থায় হযরত আলী রা. এর শরীর থেকে তীর বের করা হলে তিনি টেরো পেলেন না অথচ প্রচণ্ড ব্যথা পাচ্ছিলেন বলে নামাজের বাহিরে থাকা অবস্থায় এই তীর বের করা সম্ভব হচ্ছিল না।
নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে অলি আউলিয়াদের অভিমত:
ইমাম আবু হানিফা নামাজ ত্যাগকারীকে তওবা করে নামায আদায় না করা পর্যন্ত কোরা মারতে ও কয়েদখানায় বন্দী করে রাখতে আদেশ দিতেন। (ইসলামের আলোকে জীবন বিধান- পৃষ্ঠা নং ৪৯১ )
ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি নামাজ ত্যাগকারীকে তওবা করে আমল ও আকীদা দুরস্ত না করলে হত্যা করার হুকুম দিতেন। (মুস্তাদরকে হাকিম)
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) বেনামাজিদের সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছেন যে, নামাজ ত্যাগকারী কাফের, তাদের জানাজা পড়ো না এবং তাদেরকে মুসলমানদের গোরস্থানে দাফন করিও না। (গুনইয়াতুত তালিবিন)
এমন কি স্বেচ্ছায় নামাজ ত্যাগকারীদেরকে সাহাবায়ে কেরামগণ কাফের বলে মনে করতেন। (তিরমিজি রাসূলুল্লাহ এর নামাজ ১৭)
বড়ই আশ্চর্যের বিষয় বড়ই পরিতাপের বিষয় একজন বেনামাজী একেবারেই ভুলে যায় যে তার জীবন শুরু হয়েছিল আজান, ইকামত দিয়ে আর শেষ হবে নামাজ দিয়ে। মুসলমান মাত্রই জন্মের সময় তার ডান কানে আযান আর বাম কানে ইকামত দেওয়া হয়, এটা মুস্তাহাব। বাকি থাকে ঐ একামতের নামাজ। সেটা জানাযা দ্বারা পূর্ণ করা হয় আর চিরবিদায় হয় দুনিয়া থেকে। এটা জানার পরও মানুষ কিভাবে এত মহামূল্যবান সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নামাজ কে অবহেলা করে, স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করে। কি ভয়ংকর কথা!
নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদত: ইসলামের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো নামাজ। ঈমানের পরেই নামাজের স্থান। নামাজ সকল ইবাদতের সেরা হবার অনেক কারণ রয়েছে তার কয়েকটি নিম্নে পেশ করা হল:
ইসলামের অন্যান্য ইবাদত যেমন রোজা, হজ যাকাত ইত্যাদি ওহীর মাধ্যমে ফরজ করা হয়েছে কিন্তু নামাজ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে নিজের কাছে ডেকে এনে সোপর্দ করেছেন। এজন্যই নামাজের গুরুত্ব অন্য সকল ইবাদতের চাইতে বেশি।
নামাযে মনোযোগ স্থাপন প্রসঙ্গে হযরত হাসান বসরী (রহ) বলেন, নামাজি ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা কতগুলো নির্দিষ্ট সম্মান নির্ধারিত করে রেখেছেন। তার একটি হল: একজন ফেরেশতা নামাজীকে ডেকে বলে, হে বান্দা! তুমি যদি জানতে তোমার সামনে কে আছেন এবং নামাজের মধ্যে তুমি কার সাথে কথা বলছো, তবে খোদার কসম, কেয়ামত পর্যন্ত সালাম না ফিরিয়ে তুমি নামাজে মশগুল থাকতে।
যখন কোন বান্দা নামাজে দাড়াই তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সামনে এসে উপস্থিত হয় এমতাবস্থায় যদি নামাযী ব্যক্তি অন্য মনস্ক হয়ে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে থাকে তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন হে আমার বান্দা আমি তো তোমার সামনেই আছি আমার চাইতে বড় আর কি আছে যে, তুমি সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছ?
নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদত হওয়া প্রসঙ্গে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা বলেন,
আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার প্রধান উপায় নামাজ, নামাজ ব্যাতিত কোন ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হয় না, সালাতের কারণে রিযিকে বরকত আসে, নামাজ কেয়ামত পর্যন্ত সঙ্গে থেকে নামাজির প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করবে, নামাজ বেহেশতের চাবি এটা বেহেস্তের দরজা খুলে নামাজীকে প্রবেশ করাবে।
নামাজ না পড়ার শাস্তি: নামাজি ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন পুরস্কার রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে বেনামাজীর জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। ইহজগতে বেনামাজিকে যেসকল শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে:
– তার জীবিকা নির্বাহে কোন বরকত থাকবে না।
– তার চেহারায় নেক লোকের কোন চিহ্ন থাকে না।
– বে নামাজীর দোয়া এবং ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হয় না এমনকি তার জন্য কেউ দোয়া করলেও মহান আল্লাহর নিকট তা গ্রহণ হয় না।
– এছাড়াও বেনামাজির মৃত্যু হবে অত্যন্ত অপমানের সাথে, কবরে তাকে ভোগ করতে হবে কঠোর শাস্তি। কেয়ামতের দিন বেনামাজিকে বহু অপমান করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
– নামাজ বিনষ্টকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা নামাজ বিনষ্ট করেছে এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, সত্ত্বরই তারা কঠোর আজাবের সম্মুখীন হবে।
নামাজে উত্তম পোশাক পরিধান করার নির্দেশ: আল্লাহ তা’আলা বলেন- হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ করো। সূরা আরাফ: ৩১
সমাজে অনেক ব্যক্তি আছেন যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আত্মীয়-স্বজন, অফিস আদালতে খুব সাজগোজ করে পরিপাটি হয়ে যান কিন্তু নামাজের সময় পুরাতন, কম দামি, ময়লা হয়ে যাওয়া পোশাকটি পড়ে মহান রব্বুল আলামীনের সামনে গিয়ে হাজির হন। এটা একেবারেই ঠিক নয় বরং সর্বোৎকৃষ্ট, সবচেয়ে উত্তম পোশাকটি পড়েই সৃষ্টিকর্তার সামনে হাজির হওয়া উচিত।
তবে কারো যদি একেবারেই কাপড় না থাকে এমনকি সে যদি উলঙ্গ অবস্থায় থাকে তবে তাকে ঐ উলঙ্গ অবস্থাতেই নামাজ আদায় করতে হবে। (তাহসিব ১ম, পৃষ্ঠা ১৫০)
নামাজে খুশু বা বিনয় এর মর্যাদা: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বারবার নামাজের প্রতি বিনয়ী হওয়ার তাকিদ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- আমার স্মরনে নামাজ প্রতিষ্ঠা কর। অন্য আরেক আয়াতে বলা হয়েছে- এবং অমনোযোগীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন- অপর এক হাদীসে আছে- যার নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত না রাখে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আর অমনোযোগির নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না।
এ থেকে বুঝা গেল, যে লোক অন্যমনস্ক হয়ে নামাজ পড়ে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
ইমাম গাযযালী এর মতে খুশু বা বিনয় নামাযের শর্ত এবং নামাজের বিশুদ্ধতা এর উপর নির্ভরশীল। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. সুফিয়ান সাওরী ও হাসান বসরি (রহ) প্রমুখের মতে খুশু বা বিনয় ব্যতীত নামাজ আদায় হয় না।
কিন্তু ইমাম চতুষ্টয় এবং অধিকাংশ ফকীহগণের মতে ‘খুশু’ নামাজের শর্ত না হলেও তারা একে নামাজের রুহ বা আত্মা বলে মন্তব্য করে এ শর্ত আরোপ করেছেন যে, তাকবীরে তাহরীমার সময় বিনয় সহ মনের একাগ্রতা বজায় রেখে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাজের নিয়ত করতে হবে।
পরে নামাজের যে অংশে খুশি থাকবেনা, ঐ অংশের সোয়াব থেকে সে বঞ্চিত হবে। তবে ফিকাহ অনুযায়ী তাকে নামায পরিত্যাগকারি বলা চলবে না এবং বেনামাজির উপর যে শাস্তি প্রযোজ্য তার জন্য সে শাস্তি বিধান করা যাবে না।
শেষ কথা: হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই নামাজ আরম্ভ করতেন। আর আল্লাহ তা’আলা সে নামাজের বরকতেই তার যাবতীয় বিপদ আপদ দূর করে দিতেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার তওফিক দান করুক। আমীন।