তোফায়েল আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট: কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর হতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অষ্টগ্রাম হাওর। অষ্টগ্রামের অবস্থান হাওরের মাঝখানে। উত্তরে কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন ও ইটনা, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর, পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলা ও হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলা, পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর ও নিকলি উপজেলা।
অষ্টগ্রাম হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। তবে শীতকালে অন্যরকম সৌন্দর্য।শীতকালে হাওরের চারদিকে সবুজ ধান ক্ষেত মনে হবে যেন সবুজ গালিচা। বর্ষায় থৈ থৈ পানি আর হাওরের মাঝে ছোট ছোট গ্রাম মনে হবে যেন এক একটি দ্বীপ। ছবির সুন্দর অষ্টগ্রাম হাওর একেক ঋতুতে একেক সাজে সেজে উঠে।
বর্ষায় হাওরের মাতাল হাওয়া, জেলেদের ব্যস্ততা, ছোট বড় নৌকায় মানুষের যাতায়াত, সব কিছু মিলিয়েই চারপাশটা হয়ে উঠে দেখার মত। সদ্য নির্মিত “হাওরের বিস্ময়” নামে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইনের হাওরের উপরে দিয়ে সরীসৃপের মতো নান্দনিক সড়কটি আপনার হাওর ভ্রমণে যোগ করবে নতুন মাত্রা।
যা দেখবেন : অষ্টগ্রাম হাওর ভ্রমণের সময় অনেক কিছুই দেখতে পাবেন। হাওরে নৌকা ভ্রমণের সময় দ্বীপের মতো ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম আপনার ভ্রমণপ্রিয় মনে অন্যরকম প্রশান্তি দিবে। হাওরের রূপ দেখা ছাড়াও অষ্টগ্রামে দেখার মত আছে সাড়ে ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক কুতুবশাহ মসজিদ। সুলতানি ও মোগল স্থাপত্যের বৈশিষ্টের পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি অষ্টগ্রাম থানা সদরে অবস্থিত।
এছাড়া রয়েছে সদরে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতু, কাস্তুল ইউনিয়নের মসজিদজামে জমিদার বাড়ির মসজিদ, পাঁচশত বছরের পুরোনো ব্রহ্মানী মন্দির, ঈশা খাঁ মানসিংহের পানিপথ যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ময়দান। যদিও এই ঐতিহাসিক স্থানটির তেমন কোনো চিহ্ন নেই।
অন্যান্য স্থানের মধ্যে রয়েছে কলমা ইউনিয়নের হালালপুর গ্রামের সোয়াম্প ফরেস্ট, জলডুব ইত্যাদি।
শীতকালে যদি গ্রাম্য মেলার স্বাদ নিতে চান তাহলে আসতে পারেন মাঘ মাসের ৪ তারিখে জমে বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়নের চৌদ্দ মাদল মেলা। বহু বছর ধরে অনুষ্ঠিত এই মেলাটি অষ্টগ্রাম হাওরের ইতিহাসের গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া প্রতি মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার জমে ঐতিহাসিক কুতুব মসজিদের শাহ কুতব (রঃ) এর ওরস মোবরক। যুগ যুগ ধরে এই ওরস মোবারক পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষে দিকে পূর্ব অষ্টগ্রাম ইউনিয়নের স্থানীয় ভাষায় মৌল মিয়া সাহেবের ওরস মোবারক।
অষ্টগ্রামের ইতিহাসে এসব গ্রাম্য মেলা বহু বছর ধরে এই এলাকার মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে করেছে সমাদৃত। এসব মেলা অষ্টগ্রামের আত্মীয়তার বন্ধনকে আরো দৃঢ় করে তুলে। মেলার সময় দূর দূরান্তে থাকা সকল আত্মীয়রা গ্রামে এসে পরিবার পরিজন নিয়ে মেলা উপভোগ করে। অনেকটা ।ঈদের আমেজের মতোই হাওরবাসী তা উদযাপন করে।
এক কথায় হাওরের রূপ, অতিথির আতিথিয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবে। হাওরের মানুষের সহজ সরল ব্যবহার তাদের কৃষ্টি কালচার আপনার মনকে হারিয়ে নিয়ে যাবে।
আর বর্ষায় যদি কোন ভরা পূর্নিমায় হাওরে যেতে পারেন তবে তা হবে আপনার জীবনে কাটানো অন্যরকম একটি রাত। নৌকায় ভাসতে ভাসতে চাঁদের আলো আর সঙ্গে বাউল গান আর পুঁথি পাঠের আয়োজন এক কথায় আপনার জীবনের জন্য হবে চিরস্মরণীয় মুহুর্ত। জোৎস্না বিলাসের জন্য নৌকা ছাড়াও পছন্দমতো জায়গা দেখে ক্যাম্পিং করে ফেলতে পারেন। ক্যাম্পিং করতে অবশ্যই প্রয়োজনীয় জিনিস তাবু, হ্যামক ইত্যাদি ঢাকা থেকেই সাথে করে নিয়ে যেতে হবে।
কোথায় থাকবেন: অষ্টগ্রামে থাকার জন্যে পূর্বে ভালো আবাসিক হোটেল এর ব্যবস্থা না থাকলেও সম্প্রতি ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। অষ্টগ্রাম বাজারেই হোটেলগুলোর অবস্থান। হোটেল ঝিলিক, রংধুন, আশরাফিয়া। তবে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে রুম বুকিং দিতে হলে আগে থেকেই যোগাযোগ করতে হবে। রুম ভেদে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ০১৭১-০২৯১২২৫ / ০১৯১৪-৯৭৫৩৮৯, এই নাম্বারে ফোন করে কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নিন। কিংবা থাকার জন্যে পরিচিত কেউ থাকলে তার সাহায্য নিতে পারেন।
কোথায় খাবেন / কি খাবেন: হাওরের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ।হাওরের তাজা মাছ খেতে হলে অষ্টগ্রাম বাজারে কিছু খাবর হোটেল আছে। স্থানীয় এসব হোটেলের মাছের বিভিন্ন পদের তরকারি পাওয়া যায়। মিনহাজ ভাইয়ের হোটেল, হোটেল প্রভাতী, নাজির হোটেল উল্লেখযোগ্য। যদি পছন্দের কোনো মাছ খেতে চান তাহলে হোটেলে আগে থেকেই বলে রাখুন। সেক্ষেত্রে মিনহাজ ভাই ০১৭৪৯-৪০১২৫৫, ইলিয়াস ভাই ০১৭৪১-৫৯৩৪১৫ এই নম্বরে ফোনে অর্ডার করে রাখতে পারেন। নিজেরা রান্না করতে চাইলে সকাল সকাল স্থানীয় বাজার থেকে কিনে নিয়ে রান্না করতে পারেন।
অষ্টগ্রামে বাংলাদেশ তথা এশিয়া উপমহাদেশের সবচেয়ে সেরা পনির পাওয়া যায়। তবে এর জন্য আপনাকে এক দিন আগে স্থানীয় পনির বিক্রেতাদের পরিমাণ জানাতে হবে। পনিরের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন মিন্টু ভাইয়ের সাথে (০১৭৫৮-১২১৮৬৩)। সেই সাথে অষ্টগ্রামের ইকুরদিয়ার বিখ্যাত ৭ ইঞ্চি লম্বা মুরালির স্বাদ নিয়ে দেখতে পারেন।
কিভাবে যাবেন অষ্টগ্রাম হাওরে: অষ্টগ্রামের হাওরে আসতে হলে আপনাকে আসতে হবে ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুরে। যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ট্রেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিন সকাল ৭.১৫ মিনিটে এগারসিন্দুর প্রভাতি (বুধবার বন্ধ) ছাড়ে কিশোরগন্জের উদ্দ্যেশ্যে। এতে উঠে কুলিয়ারচর নেমে পড়ুন। ভাড়া ১১০ টাকা।
অথবা ঢাকার গোলাপবাগ থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাস যাতায়াত, অনন্যা সুপার বাসে কুলিয়ারচর আসতে পারবেন। আসতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা সময় লাগবে। ভাড়া ১৮০ টাকা।
অথবা যে কোন ট্রেনে ভৈরব রেল স্টেশনে নেমে, রিক্সায় ভৈরব বাজারে চলে আসুন। সেখান থেকে লোকাল সিএনজি ৫০ থেকে ১০০ টাকা ভাড়ায় কুলিয়ারচর চলে আসতে পারবেন।
কুলিয়ারচর নেমে একটা রিক্সা / ইজিবাইক নিয়ে চলে যান লঞ্চঘাট। এখান থেকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮ টা, ৯ টা, ১১ টা, সাড়ে ১২টা ও বিকাল ৪ টা পর্যন্ত লঞ্চ ছেড়ে যায় অষ্টগ্রাম। ভাড়া ৯০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে ৩ ঘন্টা। মনে রাখবেন কুলিয়ারচর থেকে অস্টগ্রাম গামী লঞ্চ ট্রেনের সাথে সিডিউল মেনে চলাচল করে। সম্প্রতি কুলিয়ারচর থেকে অষ্টগ্রাম স্পীড বোট চালু হয়েছে, জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়ায় এসব স্পিড বোটে যেতে পারেন। আর দলবেধে গেলে লঞ্চঘাট থেকে পছন্দ মত একটা ইঞ্জিন নৌকা ঠিক করে নিতে পারবেন আপনার প্রয়োজন মত। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা
শুকনো মৌসুমে চাইলে সড়ক পথে অষ্টগ্রাম যেতে পারেন তবে এর জন্য আপনাকে বাজিতপুর উপজেলায় আসতে হবে। ট্রেনে আসলে ভাগলপুর রেলস্টেশনে নেমে ইজিবাইকে বাজিতপুর আসতে পারেন। যদি বাসে করে আসেন তবে ঢাকা থেকে বাজিতপুরের একটি বিআরটিসি বাস সার্ভিস আছে। এছাড়া ঢাকার গোলাপবাগ থেকে কিশোরগঞ্জগামী যেকোন বাসে করে কটিয়াদি নেমে বাস স্টপ থেকেই বাজিতপুরের সিএনজি পাবেন। বাজিতপুর বাজার থেকে ইজিবাইক বা সিএনজি যোগে চলে আসুন দিঘির পাড়। ঘাটে নৌকায় ১০ মিনিটে নদী পার হয়ে দেখতে পারবেন ইজিবাইক কিংবা মোটরসাইকেল অষ্টগ্রাম গামী যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে। মোটরসাইকেলে অষ্টগ্রাম যেতে জনপ্রতি ১০০ টাকা লাগে।
সতর্কতা: অষ্টগ্রাম হাওরে এ পর্যন্ত কোনো বিব্রতকর অবস্থায় কাউকে পড়তে শোনা যায়নি। তারপরও সতর্কতা আগে। যদি ক্যাম্পিং করেন সেক্ষেত্রে অষ্টগ্রামের অষ্টগ্রাম বাজারের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। ১৫ বা এর বেশী মানুষ গেলে হয়তো স্থানীয় থানায় ওসির কাছে রিপোর্ট করতে হতে পারে, নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন। যদি নৌকায় সারা রাত পার করার ইচ্ছা থাকে তবে যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন, স্থানীয় কেউ সাথে থাকলে ভাল হয়। যেকোনো বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে অষ্টগ্রাম থানার দুটো নম্বরে ফোন দিতে পারেন: ওসি- ০১৩২০-০৯৫৭০৩, ডিউটি অফিসার- ০১৩২০-০৯৫৭০৮।
সব মিলিয়ে ঢাকার অদূরে ঘুরে আসার মতো একটি অন্যরকম স্থান অষ্টগ্রাম হাওর। তবে আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, সকল পর্যটন স্থান যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন। আপনার ব্যবহৃত পানির বোতল, পলিথিন ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিস নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। আপনার আমার একটু সচেতনতাই পরিবর্তন আনতে পারে পর্যটন খাতকে।