স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট: কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বসে ৫০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোলের হাট। কটিয়াদী উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে পুরান বাজারে প্রতিবারের মতো এবারও ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোলের হাট বসেছে।
প্রায় ৫০০ বছর ধরে জমে উঠা এই ঢাক-ঢোলের হাট এই এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। বাদ্যযন্ত্রসহ পছন্দের ঢাকিদের বেছে নিতে
কিশোরগঞ্জসহ আশে পাশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে আসা লোকজন কটিয়াদীর এই ঢাক-ঢোল হাটে। ।
জনশ্রুতি রয়েছে ষোড়শ শতাব্দির মাঝামাঝি স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় সর্বপ্রথম তার রাজপ্রাসাদে দূর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে দুই কিঃ মিঃ উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজ প্রাসাদ। পূজা উপলক্ষে রাজপ্রাসাদ থেকে বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হয় ঢাকঢোলে, বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রীদের আগমনের জন্য। সে সময় নৌপথে বাদ্যযন্ত্রীরা কটিয়াদী- মঠখোলা সড়কের পাশে পুরাতন নদের তীরে যাত্রাঘাট নামক স্থানে পূজার দুইদিন আগে আসতেন।
পরে পার্শ্ববতী মসুয়া গ্রামের বিশ্বনন্দিত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহাধুমধামে পূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে পূজায় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা চলে। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারন নিয়ে মতিবিরোধ শুরু হয়। অবশেষে স্থান পরিবর্তন করে আড়িঁয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী কটিয়াদী পুরাতন বাজারে এই ঢাকের হাট বসে। বাংলাদেশের আর কোথাও এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হাট নেই বলে জানান আয়োজকরা। হাট ব্যবস্থাপনা কমিটি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব বাদক দল ও বাদ্যযন্ত্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন এবং তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এবারও বুধবার (২১ অক্টোবর) থেকে শুরু হওয়া এ হাট সপ্তমী পূজা পর্যন্ত চলবে। ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, বি-বাড়িয়া, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েকশ’ বাদক দল বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন। বিপুলসংখ্যক পূজা আয়োজক এই হাট থেকে বাদ্যযন্ত্রীদের পূজার দু-একদিন আগে বায়না করে নিয়ে যান ঢাকিদের। এ হাটে ঢাক, ঢোল, কাঁঁসি সানাই, ঝনঝনি বিভিন্ন ধরনের বাঁশিসহ হাজার হাজার বাদ্যযন্ত্রের পসরা বসে। নেচে গেয়ে বাদ্যযন্ত্রীরা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে থাকেন।
সাধারনত একটি ঢাক ১৫-১৬ হাজার টাকা, ঢোল ৮-১০ হাজার টাকা, বাঁশি প্রকার ভেদে ৪-৫ হাজার টাকা, ১০-১২ জনের ব্যান্ডপার্টি ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চুক্তি হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ঢাকিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পূজোয় এখান থেকে ভাড়ায় গিয়ে তাদের আয় রোজগার ভালো হয়। তাছাড়া দূর্গা মায়ের আর্শীবাদও পাওয়া যায়। বংশ পরম্পরায় তারা এ হাট থেকে বায়নায় গিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিতায় সারেন।
কটিয়াদী পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বাবু দিলীপ কুমার সাহা জানান, ৫০০ বছরের কটিয়াদীর এই ঢাক ঢোলের হাট অত্র উপজেলাসহ কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যা কিশোরগঞ্জের ইতিহাসকে গর্বিত করেছে। তবে এই হাটকে ধরে রাখতে স্থায়ী একটি স্থানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে প্রশাসনের সুদৃষষ্ট্রি প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
কটিয়াদী উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বেণী মাধব ঘোষ জানান, প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে রাজা নবরঙ্গ রায় চৌধুরী আড়িয়াল খাঁ নদী তীরে এ হাটের গোড়াপত্তন করেন। আর তখন থেকেই অতীত ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে এখানে বসছে এ বাদ্যযন্ত্রের হাট।
কিশোরগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন জানান, বাদ্য ও বাদকের হাট ছাপিয়ে এটি এখন পরিণত হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ভিন্ন রকম শৈল্পিক মিলন মেলায়।