তোফায়েল আহমেদ ও মিয়া মোহাম্মদ ছিদ্দিক: মোঃ শরীফুল ইসলাম গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া এলাকার বাসিন্দা। সদ্য বিবাহিত শরীফুল পেশায় একজন ব্যবসায়ী। কুড়িখাই গ্রামের লাভলী আক্তার তার স্ত্রী। এবারই তার শ্বশুরবাড়িতে প্রথম মেলা উদযাপন। মেলায় এসেছেন মাছ কিনতে। ১০ হাজার টাকায় কিনলেন বড় আকারের একটি রুই মাছ। হাসিমুখে তা নিয়ে যাচ্ছেন শ্বশুরবাড়ি।
লোকমুখে শুনতাম কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার কুড়িখাই মেলার কথা। এখন আমি এই কুড়িখাই গ্রামেরই জামাই। জামাই মেলা থেকে জামাইরা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা একসময় শুনে থাকলেও আজ মেলা থেকে নিজে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। জামাই মেলার জামাই মাছ কিনে নতুন জামাই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। এই মাছ দিয়েই হবে জামাই আদর। এ যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। এভাবেই কুড়িখাই মেলায় এসে অনুভূতির কথা বলছিলেন শরীফুল।
কিশোরগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অংশ কটিয়াদী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা। ৩৬০ আউয়ালিয়ার শিরোমনি শাহ জালাল (রহঃ) এর সফর সঙ্গী এবং ১২জন আউলিয়ার অন্যতম একজন হযরত শাহ শামছুদ্দিন বুখারী (রহঃ)। আনুমানিক বাংলা ১২২৫ সালে ৩ জন সঙ্গী শাহ নাসির, শাহ কবীর ও শাহ কলন্দরকে নিয়ে কটিয়াদী উপজেলার কুড়িখাই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন হযরত শাহ শামছুদ্দিন বুখারী (রহঃ)। তিনিই এ অঞ্চলের প্রথম ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাঁর ইহলোক ত্যাগের পর স্থানীয় ভক্তরা প্রায় ৮শত বছর পূর্বে ওরসের প্রচলন শুরু করেন বলে জানা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারী) থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা। প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ সোমবার কুড়িখাই শাহ শামছুদ্দিন বুখারী (রহঃ) মাজারে সপ্তাহব্যাপী মেলা শুরু হয়। মেলা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা আাসা শুরু করেন। সপ্তাহব্যাপী চলে মেলার উদযাপন। মেলাটি যুগ যুগ ধরে কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সমাদৃত করছে। এছাড়া কুড়িখাই মেলাকে ঘিরে তৈরী হয় পারষ্পরিক আত্মীয়তার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। মেলায় আসার জন্য একে অপরকে বিভিন্ন মাধ্যমে দাওয়াত করে বাড়িতে এনে চলে আতিথেয়তা।
মেলাকে উপলক্ষ্য করে প্রত্যেক বাড়ীতে জামাইদের দাওয়াত করে জামাই আদরের প্রচলন রয়েছে। মেলা উপলক্ষ্যে এ অঞ্চলের জামাইদের বিশেষভাবে দাওয়াত দেয়া হয় এবং মেলার প্রধান আকর্ষন “জামাই মেলার” মাছের হাট। মাছের হাটে দেখা মেলে বড় আকারের রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল, আইড়, বাঘা আইড়, পাঙ্গাস, কার্প, সিলভার কার্পসহ বাহারী মাছের।
মেলা প্রাঙ্গনের পাশেই বসে বিশাল এই মাছের বাজার। রীতি অনুয়ায়ী এলাকার মেয়েদের জামাইদের দাওয়াত দেওয়া হয়। জামাইদের মধ্যে মাছ কেনা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা, কে কত বড় মাছ কিনে শ্বশুর বাড়ি গেলো এই নিয়ে চলে মাতামাতি। আর সেই মাছ দিয়েই হয় শ্বশুরবাড়িতে জামাইদের আপ্যায়ন। মেলার পুরো সময় ধরেই এলাকায় বিরাজ করে আনন্দঘন পরিবেশ।
প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ঘিরে বসে মেলা। মেলায় কাঠের জিনিসপত্র, মিষ্টি, খেলনা, মিঠাই, মন্ডা, মুড়ি ও বিন্নি খইসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিসের বিরাট হাট বসে। এছাড়াও বিনোদনের ব্যবস্থা হিসেবে বসে সাকার্স, পুতুল নাচ, নাগরদোলাসহ নানা আয়োজন।
বিভিন্ন ধাপে চলে মেলার আয়োজন। সোমবার ওরস মোবারক ও মুড়ি খই মেলা, মঙ্গলবার মাছের মেলা , বুধবার বউ মেলা, বৃহস্পতিবার জামাই মেলা, শুক্রবার মিলন মেলা, শনিবার আনন্দ মেলা ও রবিবার থেকে সপ্তাহব্যাপী কাঠের মেলা ও সাধারন মেলা থাকে। মেলার বিশেষ আকর্ষন হিসেবে শেষ ২ দিন বসে বউ মেলা। শুধুমাত্র এলাকার বিভিন্ন বয়সের মহিলারা মেলায় এসে কেনাকাটা করে থাকেন। মেলা দেখেতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় লক্ষাধিক লোকের আগমন ঘটে।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ সংবাদদাতাকে জানান, হযরত শাহ শামছুদ্দিন বুখারী (রহঃ) আউলিয়ার ওরস উপলক্ষ্যে কুড়িখাই মেলা কিশোরগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমাদৃত করেছে। মেলাটি এখন আর মেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মেলাটি এখন পারষ্পরিক আত্মীয়তার এক মিলন মেলাতে পরিণত হয়েছে। মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখে কিশোরগঞ্জের ইতিহাস রক্ষায় আমাদের সকলের কাজ করতে হবে।
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি ও কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ আকতারুন নেছা জানান, এই মেলা ও উৎসবকে কেন্দ্র করে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মেলার নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মেলা আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ মঈনুজ্জামান অপু জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসব। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে এ মেলায় আসার আহবান জানান তিনি।