খন্দকার আবু সুফিয়ান: মুজিব শব্দের অর্থ? উত্তরদাতা। তেমনিভাবে তিনি তিনি হাজার বছরের শোষিত পরাধীন জাতিকে স্বাধীকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়ে আমাদের উত্তরটা দিয়ে গেলেন, বাঙ্গালী জাতি স্বাধীন। বাঙ্গালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, একটি নতুন মানচিত্রের অমর রূপকার। বড় বিচিত্র, বর্ণাঢ্য আর কীর্তিতে ভরা তাঁর সারাটা জীবন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান। তিনি কখনও ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি। বাংলাদেশকে সকল ধর্মের সকল মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে তিনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গ্রহণ করেছিলেন বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও তিনি।
জন্ম: বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ (সাবেক ফরিদপুর) জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল খোকা। শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের আদরের ‘খোকা’ই পরবর্তীত আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর হয়ে উঠেছিলেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামে প্রকৃতির নিবিড় আশ্রয়ে জল-মাটি-কাদায় হেসে-খেলেই তার শৈশব কেটেছিল।
চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। কারণ তার চোখে জটিল রোগের কারণে সার্জারি করাতে হয়েছিল এবং সেরে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
বঙ্গবন্ধুর সপ্তম পূর্বপুরুষের বঙ্গে আগমন: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়াল। (শেখ মুজিবুর রহমান, পিতা শেখ লুৎফুর রহমান, পিতা শেখ আবদুল হামিদ, পিতা শেখ তাজ মাহমুদ, পিতা শেখ মাহমুদ ওরফে তেকড়ী শেখ, পিতা শেখ জহির উদ্দিন, পিতা দরবেশ শেখ আউয়াল।) তিনি হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ)-এর প্রিয় সঙ্গী ছিলেন। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি বাগদাদ থেকে বঙ্গে আগমন করেন। পরবর্তীকালে তাঁরই উত্তর-পুরুষেরা অধুনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। জাতির জনক হচ্ছেন ইসলাম প্রচারক শেখ আউয়ালের সপ্তম অধঃস্তন বংশধর। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। নানার নাম ছিল শেখ আব্দুল মজিদ। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের (মৃত্যু : ১৯৭৪ খ্রি:) সুখ্যাতি ছিল সূফী চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। জাতির জনক নিজেও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ইসলামী তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন: তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। তিনিই আমাদের শিরায়-উপশিরায় জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রকে সঞ্চারিত করেছেন। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের এক আপসহীন সংগ্রামী নেতা তিনি। আমাদের বিস্মৃত জাতিসত্তাকে তিনি জাগ্রত করেছেন। আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন মহান স্বাধীনতার সংগ্রামে, মুক্তির সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর জীবন তাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে অভিন্ন ও একাত্ম। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও আমাদের স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। তিনি ছিলেন জনগণের পক্ষে। স্বাধীন মতপ্রকাশের পক্ষে। শোষণ ও বঞ্চনার বিপক্ষে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খল ও শোষণমুক্তির প্রবল আকাঙ্ক্ষাই ছিল তার সংগ্রামী জীবনের মূল কথা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চুয়ান্নর নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান তার গণতান্ত্রিক চেতনা, শৃঙ্খল ও শোষণমুক্তির উদগ্র বাসনাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
তিনি তার ব্যক্তিসত্তাকে বাঙালি জাতিসত্তায় রূপান্তরিত করেছিলেন। নিজের স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তাই তিনি পরিণত হয়েছিলেন বাংলার সব বর্ণের, সব ধর্মের, সব মানুষের এক অবিসংবাদিত নেতায়। তিনি পুরো দেশকে জাগিয়েছিলেন। তার কথায় বাঙালি উঠত-বসত। তার অঙ্গুলিহেলনে সারা দেশ থমকে যেত। গাড়ির চাকা থেমে যেত। কোর্ট-কাছারি বন্ধ হয়ে যেত। তার কথায় বাঙালি কাঁদত-হাসত। তার জন্য মানুষ প্রার্থনা করত। তিনি ছিলেন বাঙালির এক মুকুটহীন সম্রাট। তাই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু তাই অভিন্ন। একে অপরের পরিপূরক।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশ নামকরণ: ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় ‘বাংলাদেশ’ নামটি চূড়ান্ত করেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। বর্তমানে এই দিনটি ‘বাংলাদেশ দিবস’ বা ‘বাংলাদেশের নামকরণের দিবস’ হিসেবেই পালিত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়: ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা: ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা, প্রচার-প্রসার এবং এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামগ্রিক জীবনকে মহান ইসলামের কল্যাণময় স্রোতধারায় সঞ্জীবিত করার মহান লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ এবং ‘ইসলামিক একাডেমি’ নামক তৎকালীন দুটি সংস্থার বিলোপ সাধন করে এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন সরকারী অর্থে পরিচালিত অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসেবে নন্দিত। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ যাবত পবিত্র কুরআনের বাংলা তরজমা, তাফসির, হাদিস গ্রন্থের অনুবাদ, রাসূল (সাঃ)-এর জীবন ও কর্মের উপর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন ও দর্শন, ইসলামী অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবী ও মনীষীগণের জীবনী ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়সহ সারা দেশে ৬৪টি জেলা কার্যালয়, আর্ত-মানবতার সেবায় ২৮টি ইসলামিক মিশন, ৭টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির মাধ্যমে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বৃহত্তর কলেবরে ২৮ খণ্ডে ইসলামী বিশ্বকোষ, ১২ খণ্ডে সীরাত বিশ্বকোষ প্রকাশ করে ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে।
সীরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠা: বঙ্গবন্ধু দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সীরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেন।
পবিত্র কোরআনের ২২নং সূরা হজ্বের ৪০নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘আমি ইচ্ছা না করলে পৃথিবীতে মঠ, মন্দির, গির্জা ও মসজিদ কিছুই থাকত না।’ অর্থাৎ কোরআনেই ধর্মীয় বহুত্ব স্বীকৃত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু ’৭২- এর জানুয়ারি থেকে ’৭৫- এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৩১৪ দিন যে বাংলাদেশ গড়েছিলেন এবং ইসলামসংক্রান্ত যে অবদান রেখেছিলেন, তাতে এ চারটি প্রভাবের প্রতিফলন ছিল। বক্ষমান আলোচনার উৎস তার বিভিন্ন ভাষণ-বক্তব্য এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো।
বঙ্গবন্ধুর (নির্বাচিত) ভাষণ ও বক্তব্য: ১৯৭০-এর নভেম্বরে প্রাকনির্বাচনী বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। … লেবেলসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসূলে করিম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। … যে দেশের ৯৫ শতাংশ মুসলমান সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়স্তা করে তোলার কাজে।’
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়।’
একই বছর ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটি মানে আছে।
এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’ ১২ অক্টোবর, ১৯৭২ গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। বাংলার মানুষ এটি চায় না। যদি কেউ করে, তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যাত করবে।’ ৪ নভেম্বর, ১৯৭২-এ গণপরিষদের ভাষণে একই কথা পুনরায় বলা হয়েছিল।
১৯৭৪-এর ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু তার আজন্ম লালিত ধর্ম-দর্শন আরও বিস্তৃত করে বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নিচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন, তিনি রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, সব মানুষ তার কাছে সমান।’
উপর্যুক্ত ভাষণগুলো সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যে দিকনির্দেশনা ছিল, তার বেশক’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, বাংলাদেশ গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও আদর্শগতভাবে হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দ্বিতীয়ত, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; এর মানে ধর্মীয় বহুত্বের স্বীকৃতি ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। তৃতীয়ত, ধর্মের নামে রাজনীতি ও ব্যবসা নিষিদ্ধ হবে বাংলাদেশে। চতুর্থত, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা যাবে না বা ধর্মান্ধতা চলবে না। সর্বোপরি অনুসৃত ও আচরিত ইসলাম হবে মৌল ইসলামী চেতনালগ্ন।
পদক্ষেপগুলো: বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাকিস্তান আমলে ছিল রেসকোর্স এবং সেখানে রোববার ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে চলত বাজি ধরার জুয়া, যা ছিল উপনিবেশ আমলের ধারাবাহিকতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অনৈসলামিক ঘোড়দৌড় বন্ধ হয় এবং রেসকোর্সের নামকরণ করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যদি মনে করো আগামীকাল কেয়ামত হবে, তবুও আজ একটি চারা রোপণ করো।’ দেখা যায়, নবী (সা.)-এর এমন নির্দেশ অনুসারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বৃক্ষশোভিত করার কাজ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে।
পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। স্বাধীনতার পর প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের হাজীদের ওপর সৌদি নিষেধাজ্ঞা ছিল। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং বঙ্গবন্ধুর আমলে ৬ হাজার ৬০০ জন হজ সম্পন্ন করেন।
ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নামের নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়, যা পাকিস্তান আমলে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে কোরআন তেলাওয়াত ও তাফসির প্রচার শুরু হয়।
উল্লেখ্য, ব্যবস্থাটি মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই চালু আছে। তাবলিগ জামাতকে একটি অরাজনৈতিক দীনী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু তাদের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমার জন্য টঈীতে একটি সুবিশাল প্রাঙ্গণ বরাদ্দ দেন।
মুসলিমদের অন্যতম বৃহৎ সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত তাবলিগ ইজতেমা আজ অনুষ্ঠিত হতে পারছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে।
উল্লেখ্য, কাকরাইল মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলিগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। ’৭২-এর আগে মসজিদটি ছিল অপরিসর। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অতিরিক্ত স্থান বরাদ্দ করা হয়; ফলে মসজিদটি সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানের আকার ধারণ করে।
বঙ্গবন্ধু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ধর্মকে গুরুত্ব না দেয়া দেশে তাবলিগ জামাতের প্রচার কাজ সম্প্রসারণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সে দেশে বঙ্গবন্ধুর আমলে তাবলিগ জামাতের প্রতিনিধি দল গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ দুরূহ কাজটি সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তার হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে এখন তাবলিগ জামাতের যে প্রচার কাজ চলমান, তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭৩-এ আরব-ইসরাইল যুদ্ধে অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধরত আরব দেশগুলোর সৈনিকদের জন্য ১ লাখ পাউন্ড চা ও ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, অন্যান্য দেশ থেকে পাঠানো মেডিকেল টিমের মধ্যে বাংলাদেশেরটি ছিল সবচেয়ে বড়।
’৭৪-এ লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (বর্তমান নাম ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা) অধিবেশনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সংস্থাটির সদস্য ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বাস্তবধর্মী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এখানে দুটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক।
এক. মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ বৈরী ছিল। কারণ তারা বর্বর পাকিস্তানি প্রচারণায় বিশ্বাস করেছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারত প্ররোচিত ইসলামী সংহতি বিনষ্টকারী একটি অপপ্রয়াস মাত্র। অবশ্য তাদের ভুল ভাঙ্গাতে দেরি হয়নি।
দুই. যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য পেট্রোডলার প্রয়োজন ছিল। এ দুটো বিষয় বিবেচনায় নিলে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের বাস্তবতা ও দূরদর্শিতা বোধগম্য হয়।
বঙ্গবন্ধুর ইসলাম ছিল ইসলামের মর্মশাঁসলগ্ন, ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ইসলাম নয়। অন্যদিকে তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ধর্মীয় গণতন্ত্র বা ধর্মীয় বহুত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন। বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্য বহুত্বের ও সহিষ্ণুতার।
ফলে বঙ্গবন্ধুর আমলে ইসলামী মূল্যবোধ যেমন সংরক্ষিত ও বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি অন্যান্য ধর্মও অবস্থান করেছে স্বমহিমায়। ধর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কারাভোগ জীবনী: বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের রাজনৈতিক সচিব, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন।
এর মধ্যে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাতদিন কারাভোগ করেন বঙ্গবন্ধু, বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তার জেলে কাটে পাকিস্তান আমলে।
কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয় বলে তোফায়েল আহমেদ জানান। তিনি বলেন, সে সময়ে বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারা ভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ’৬৪ ও ’৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। ছয় দফা দেওয়ার পর জাতির পিতা যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড: ১৯৭৫ খ্রি. ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫৪ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী অফিসার বিশ্বাস ঘাতকের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শেখ কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নীপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে ঘাতকরা হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন। বাঙালি জাতি এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে এবং সাথে সাথে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তাঁর সাহস, শৌর্য, আদর্শের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালি জাতির অন্তরে।
লেখক: খন্দকার আবু সুফিয়ান, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী, অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ।